top of page

।। শ্রীরামচন্দ্রের মাংসাহার প্রসঙ্গের মীমাংসা।। পর্ব-১

Updated: Jul 13, 2021






শ্রী রামচন্দ্র কি মাংসাহারী ছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে রয়েছে বিশাল যুক্তিতর্ক। একদল বলছে রামজী মাংসাহারী ছিলেন না, আরেক দলের দাবী রামজী মাংস খেতেন। যদিও আদি সনতানী পরম্পরা যথাঃ- শঙ্কর, রামানুজী, মাধ্ব, নিম্বার্ক, বল্লভ, রামানন্দী, গৌড়ীয়াদি পরম্পরা এই ব্যাপারে একমত যে, রামচন্দ্র মাংসাহারী ছিলেন না। তারপরও অনেকেই নিজেকে পরম্পরার অংশ দাবী করে বা না করে পরম্পরা সিদ্ধ কথাটির বিরুদ্ধে নানান যুক্তি দাঁড় করায়, যেগুলো নেহাৎ উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। তাই বিষয়টার একটা মীমাংসা প্রয়োজন। এই মীমাংসার উদ্দেশ্য নিয়েই বিষয়টা নিয়ে পর্ব আকারে লিখা শুরু করলাম।


জয় শ্রী রাম।।


এই পর্বে আলোচনা করবো বাল্মিকী রামায়ণের থেকে রামের পিতৃসত্য পালনের জন্য বনে যাওয়ার পূর্বে ও যাত্রাপথে বিভিন্ন জনের সাথে বার্তালাপের কিছু অংশ এবং মাতা সীতার সহিত লঙ্কায় সাক্ষাতের সময় হনুমানজীর কিছু কথা নিয়ে।


যখন শ্রী রামচন্দ্রের বন গমনের আজ্ঞা হলো তখন তিনি নিজ মাতা কৌসল্যার নিকট অনুমতি নেবার জন্য আসেন। সেই সময় শ্রীরামচন্দ্র বলেন-


#(1) স ষট্ চাষ্টৌবর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে । আসেবমানো বন্যানি ফলমূলৈশ্চ বর্তয়ন্ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.২০.৩১)
>>[আমি] চৌদ্দ বৎসর কাল নির্জন বনে[বিচরণ এবং] ফলমূল আহার করে অবস্থান করব ।



তারপূর্বে ২৯ নং শ্লোকে এ শ্রী রামচন্দ্র মাতা কৌসল্যাকে বলছেন-


#(2) চতুর্দশ হি বর্ষাণি বৎস্যামি বিজনে বনে। কন্দমূলফলৈর্জীবন্ হিত্বা মুনিবদামিষম্।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.২০.২৯)
>> (আমি) মুনিদের মতো আমিষ আহার ত্যাগ করে কন্দমূল ও ফলাহার দ্বারা জীবনধারণপূর্বক চৌদ্দ বৎসর জনহীন অরণ্যে বাস করব।


পিতা দশরথের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় পিতা দশরথকে শ্রী রামচন্দ্র বলেন-

#(3) ফলানি মূলানি চ ভক্ষয়ন্ বনে গিরীংশ্চ পশ্যন্ সরিতঃ সরাংসি চ । বনং প্রবিশ্যৈব বিচিত্রপাদপং সুখী ভবিষয়ামি তবাস্তু নির্বৃতিঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.৩৪.৫৯)
>>বনে প্রবেশ করে ফলমূল ভক্ষণ করব ; বনের পর্বত , নদী ,সরোবর এবং বিচিত্র সব বৃক্ষ দেখে সুখে থাকব । আপনার মনে শান্তি বিরাজ করুক ।


ভরদ্বাজ মুনিকে নিজের বনবাসের কারণ সম্পর্কে বলে শ্রীরামচন্দ্র বলেন -

#(4) পিত্রা নিযুক্তা ভগবন্ প্রবেক্ষ্যামস্ত পোবনম্ । ধর্মমেবাচরিষ্যামস্তত্র মূলফলাশনাঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.৫৪.১৬)
>>ভগবন্ ! পিতা কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে আমরা তপোবনে প্রবেশ করব এবং সেখানে ফলমূলাহারী হয়ে ধর্মাচারণ করব ।


শ্রীরামচন্দ্র জাবালির নাস্তিকমত খণ্ডনের সময় বলেন-

(#৫) বনবাসং বসন্নেব শুচির্নিয়তভোজনঃ । মূলপুষ্পফলৈঃ পূণ্যৈঃ পিতৃন্ দেবাংশ্চ তর্পয়ন ।। সন্তুষ্টপঞ্চবর্গোহহং লোকযাত্রাং প্রবাহয়ে । অকুহঃ শ্রদ্দধানঃ সন্ কার্যাকার্যবিচক্ষণঃ ।। (বাল্মিকী রামায়ণ ২.১০৯.২৬-২৭)
>>বনবাসে থেকে নিয়ত পবিত্র-মূল-পুষ্প আহার ও পিতৃদেবদের তৃপ্তি বিধান এবং পঞ্চেন্দ্রিয়ের তৃপ্তি বিধান করে লোকযাত্রা নির্বাহ করব এবং অকপট শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্যাকর্তব্য বিচক্ষণ হব ।


উপরোক্ত শ্লোক গুলো হতে দেখা যাচ্ছে, শ্রী রামচন্দ্র মাতা কৌসল্যা ও পিতা দশরথকে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন বনে গিয়ে ফলমূল খাওয়ার ভরদ্বাজ মুনিকে বলছেন তার পিতৃসত্য পালনের কথা, তথা ১৪ বছর বনবাস ও বনে গিয়ে ফলমূল খাওয়ার কথা আবার জাবলীকেও বলছেন তিনি বনবাসে থেকে ফলাহার করবেন ও এই ব্যাপরে তিনি শ্রদ্ধাশীল ও কর্তব্য পরায়ণ হয়ে বিচক্ষণ ভাবে তার কর্তব্য পালন করবেন। কৌশল্যা মাতাকে তিনি বলেছেন বনবাসের সময় মুনিদের ন্যায় আমিষ আহার ত্যাগ করবেন।


অর্থাৎ বনে গিয়ে রামচন্দ্রের শুধু ফলমূল আহার করার কথা রামচন্দ্রের বচনে স্পষ্ট প্রকাশ পায়।

রামচন্দ্রের দুটি বিখ্যাত প্রতিজ্ঞা আছে। যথাঃ-

এক তো তিনি তাহার মাতা কৈকেয়ীর সম্মুখে প্রকট করেছিলেন -
#(6) " রাম দ্বির্নাভিভাষতে" (২|১৮।৩০) অর্থাৎ, রাম দ্বিচারী নয় বা দুইরকম কথা বলেন না।


দ্বিতীয় প্রতিজ্ঞা তিনি সীতাজীর সম্মুখে এই রূপে রেখেছিলেন -

#(7) অপ্যহং জীবিতং জহ্যাং ত্বাং বা সীতে সলক্ষ্মণম্। ন তু প্রতিজ্ঞাং সংশৃত্য ব্রাহ্মণেভ্যো বিশেষতঃ।। (৩|১০।১৮ )
>> সীতে! আমি নিজের জীবন, এমনকি লক্ষ্মণসহ তোমাকেও ত্যাগ করতে পারি, কিন্তু প্রতিজ্ঞা, বিশেষত ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি অবহেলা করতে পারি না।


অর্থাৎ শ্রীরাম কখনো দুইকথা বলেন না। তার প্রাণ গেলেও তিনি কখনো কথা ঘুরাবেন না। আর কাউকে কথা দিলে তা প্রাণের বিনিময়ে হলেও রাখবেন। সুতরাং শ্রীরামচন্দ্র যে পূর্বে মাতা ও পিতাকে কথা দিয়েছেন আমিষ আহার বর্জন করে ফলমূল আহার করবেন তার অনর্থ কখনো হতে দিবেন না। তার সেই প্রতিশ্রুতি তিনি অবশ্যই রক্ষা করবেন। আবার মুনি ভরদ্বাজ ও নিষদরাজ গুহের কাছে যে তিনি তার বনে গিয়ে ফলমূল আহারের কথা বললেন, এই কথার অন্যথা কখনো করবেন না শ্রীরামচন্দ্র, কেননা তিনি দ্বিচারী নন।


আবার লঙ্কায় মাতা সীতার সাথে সাক্ষাৎ করার সময় হনুমানজী বললেন,

#(8) ন মাংসং রাঘবো ভুঙ্ক্তে ন চৈব মধু সেবতে। বন্যং সুবিহিতং নিত্যং ভক্তমশ্নাতি পঞ্চমম্।। (সুন্দরকান্ড -৩৬/৪১)
>> রাঘববংশের কেউ মাংস ভক্ষণ করেন না, মধু পানও করেন না। শ্রী রামচন্দ্র নিত্য চারপ্রহর উপবাসে থেকে পঞ্চম প্রহরে শাস্ত্র বিহিত বন্য ফল-মূল ও নীবার অন্নাদী ভোজন করেন।


এখানে হনুমানের কথায়ও স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে রামচন্দ্র মাংসাহারী নন।


উপরোক্ত শ্লোক গুলোয় পূর্বপক্ষের(পূ.প.) শঙ্কা উত্তরপক্ষদ্বারা(উ.প.) নিরসনঃ-


পূ.প.- উক্ত ২.২০.৩১, ২.৩৪.৫৯, ২.৫৪.১৬, ২.১০৯.২৬-২৭ এ তো রামচন্দ্র বলছেন বনে গিয়ে ফলমূল আহার করবেন, এটা তো বলেন নি যে, তিনি মাংসাহার করবেন না। তাহলে তো বনে গিয়ে মাংস খেলে কোনো সমস্যাও নাই।


উ.প.- ধরুন কেও একজন বলল, 'আমি শাকাহারী'। এখন এর অর্থ যদি যদি আপনি ধরে নেন যে, " সে বলেছে সে শাকাহারী, সে তো বলে নাই যে সে মাংস খায় না। সুতরাং সে মাংস খেতেই পারে।" তাহলে সেটা আপনারই বোকামী হবে। কেউ যদি আজ নিজেকে শাকাহারী দাবী করে কাল মাংসাহার করে তাহলে সে ভন্ড ও দ্বিচারী। আর প্রভু শ্রীরামচন্দ্র কখনোই এমন দ্বিচারী ছিলেন না, তা তার কথায় (২.১৮.৩০) এ স্পষ্ট বলা আছে। তারপর ২.২০.২৯ এ তো তিনি আরো স্পষ্ট করে বলেছেন, "মুনিদের মত আমিষ আহার ত্যাগ করে ফলমূল আহার করবো"। অর্থাৎ রামচন্দ্র বনে গিয়ে শুধু ফলমূল আহারের কথাই স্পষ্ট করে বলেছেন, অন্যকিছু আহারের ইঙ্গিত করেন নি।


পূ.প.- তাহলে যেহেতু, ২.২০.২৯ এ মুনিদের মত ত্যাগ করবেন বলেছেন, সেহেতু কিছু কিছু মুনি তো মাঝে মাঝে আমিষ আহার করতেন। তাহলে তো রামচন্দ্রও ঐ মুনিদের মত আমিষ আহার করতেও পারেন, তাতে সমস্যা কোথায়? তিনি তো মুনিদের মত ত্যাগ বলেছেন।


উ.প.- বেশ। যেসকল মুনি আমিষ আাহার করেন তারা আমিষ আহার ত্যাগী হলেন কিভাবে? রামচন্দ্র মুনিদের মতো ত্যাগ বলেছেন, অর্থাৎ যেসকল মুনিরা আমিষ আহার করেন না বা আমিষ আহার ত্যাগ করেছেন, তাদের বুঝিয়েছেন। নয়তো যেসব মুনিরা মাংস খায় তাদের মত করে বললে রামচন্দ্র বলতেন যে, " মুনিদের মত মাংসাহার করবো"। সংস্কৃত "হিত্বা" অর্থাৎ ত্যাগ শব্দটা উল্লেখ করতেন না। কারণ ত্যাগ মানে কখনোই মাঝে মাঝে ভোগ নয়। মাঝে মাঝে ভোগ করে ত্যাগ শব্দ ব্যবহারকে ভন্ডামি বলে৷ যেমন- এখন কেউ যদি বলে, " আমি সন্ন্যাসী, গৃহত্যাগী। তবে মাসে একবার গৃহে যাই ভোগ করি। আমার স্ত্রী আছে, স্ত্রী ভোগ করি। কিন্তু আমি সন্ন্যাসী গৃহত্যাগী। মাঝে মাঝে ভোগ করি আরকি।" তাহলে তাকে সন্ন্যাসী নয় ভন্ড বলতে হবে। আর বেশিরভাগ মুনিগণই আমিষ আহার ত্যাগীই ছিলেন। তারা আমিষ আহারের বিরুদ্ধে বলতেন। যেমন- মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে নারদ, ভীষ্ম, দেবগুরু বৃহস্পতি, মার্কন্ডেয় ঋষির মত বড় বড় মুনি ও মহাত্মাগণের মতামত দেখে নেই-

ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলছেন-

#(9a) তপস্বী বিচক্ষণেরা মাংসাহার করেন না(২১)


#(9b) নরাদমুণির মতে যে পরমাংস দ্বারা নিজের বৃদ্ধি সাধন করতে চায় সে অবসন্ন হয়।(৪৩)
#(9b) দেবগুরু বৃহস্পতির মতে, সাধুরা মাংসাহার রহিত হইয়াই যজ্ঞ, দান, তপস্যা করে থাকেন।(৪৪)



#(9c) জ্ঞানীরা মাংসাহার ত্যাগের প্রশংসা করেন।(৫০)


#(9d) সংযতচিত্ত মহর্ষিগণ বলেন যে, মাংস ভক্ষণ না করায় আয়ু, যশ, স্বর্গ ও বিশেষ মঙ্গল হয়।(৬৬)
#(9d) মার্কন্ডেয় ঋষির মতে, মাংসাহারীগণ পাপী(৬৭-৬৮)


উপরোক্ত মহাভারতের অনুশাসন পর্বের ১০০ তম অধ্যায়ে ভীষ্ম, বৃহস্পতি, মার্কন্ডেয়, নারদের মত মুনি মহাত্মাদের বচনে মাংসাহারের বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে। ২১, ৪৪,৫০,৬৬ শ্লোকে দেখা যাচ্ছে, তপস্বী, সাধু, জ্ঞানী, সংযতচিত্ত মহর্ষিগণ মাংস ভক্ষণ করেন না।

আবার রামায়ণে ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে যখন শ্রীরামচন্দ্র গিয়েছিলেন তখন ভরদ্বাজ মুনির সাথে রামচন্দ্র ফলমূল ভোজন করেছিলেন-

#(10) নানাবিধানন্নারসান্ বন্যমূলফলাশ্রয়ান্। তেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসং চৈবাভ্যকল্পয়ৎ।। (বাল্মিকী রামায়ণ- ২/৫৪/১৮)
>> তখন উগ্র তপসয়ার তাপে উত্তপ্ত সাংসারিক বন্ধন যাঁর (সেই ঋষি ভরদ্বাজ) তাঁদের( রাম, লক্ষ্মণ, সীতা) জন্য বনজাত নানাবিধ ফলমূল ও পানীয় আহরণ করলেন এবং উপযুক্ত বাসস্থানেরও ব্যবস্থা করলেন।


আবার যখন মহর্ষি বিশ্বামিত্র, মহর্ষি বশিষ্ঠের আশ্রমে পাদচারণ করেন তখন মহর্ষি বশিষ্ঠ মহর্ষি বিশ্বামিত্রকে ফলমূলাদি দিয়ে আপ্যায়ন করেন-

#(11) উপবিষ্টায় চ তদা বিশ্বামিত্রায় ধীমতে। যথান্যায়ং মুনিবরঃ ফলমূলমুপাহরৎ।। (বাল্মিকী রামায়ণ-১/৫২/৩)
>> তখন প্রদত্ত আসনে উপবিষ্ট প্রজ্ঞাবান বিশ্বামিত্রকে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠদেব শাস্ত্রবিধি অনুসারে ফলমূলাদি উপহার দিয়ে আপ্যায়ন করলেন।


সুতরাং মুনিরা সাধারণত মাংসাহার করেন না এটা স্পষ্ট।

এবার কোনে মুনি যদি কোনে বিশেষ কারণে মাংস খেয়েও নেন তথাপি সেই ব্যাতিক্রম ঘটনা কখনো সাধারণ উদাহরণ হিসেবে টানা অনুচিত। কারণ ব্যাতিক্রম কখনো উদাহরণ হয় না।


পূ.প.- আচ্ছা বেশ! এখানে রামজী বলেছেন, মুনিদের মতো আমিষ আহার তয়াগ করবেন, এর মানে কি? রামচন্দ্র কি পূর্বে আমিষ আহার করতেন যে এখন ত্যাগ করবেন?


উ.প.- প্রথমত বনবাসের পূর্বে রামজীর আমিষ আহার তথা মাংসাহার করেন নাই। বাল্মিকী রামায়ণে তার বিবরণ নই। দ্বিতীয়ত ত্যাগের অর্থ সবসময়, পূর্বে ভোগ করতো, এখন ছেড়ে দিয়েছে অর্থাৎ ছেড়ে দেওয়া আর্থে বয়বহৃত হয় না। আর এখানে মূল সংস্কৃত শব্দ 'হিত্বা' এর বাংলা অর্থ হয়েছে ত্যাগ। #(12) ত্যাগ শব্দ বর্জন, পরিহার, ছেড়ে দেওয়া বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। এখানে ত্যাগ শব্দটি পরিহার করা অর্থে বয়বহৃত হয়েছে।


যেমন- এক সুবোধ বালক বাড়ি ছেড়ে দূরে কোনো এলাকায় পড়াশোনা করতে যাবে। পূর্বে সে কখনো ধূমপান ও খারাপ সঙ্গ করে নি। বালকটি চলে যাওয়ার আগে তার মা কে বলল, " মা, তুমি আমার জন্য চিন্তা করো না। আমি মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করব এবং খারাপ সঙ্গ, খারাপ কাজ ও ধূমপান পরিহার করে চলব। " এর মানে তো আর এই না যে সে পূর্বে ঐ খারাপ সঙ্গ, ধূমপান এসব করতো, বাইরে গিয়ে ছেড়ে দিবে। এখানে ছেড়ে দেওয়া অর্থ গৃহীত হয় নাই। পরিহার অর্থ গৃহীত হয়েছে। অর্থাৎ ছেলেটি পূর্বে তো ঐসব অকাজ করতোই না বরং দূরে গেলেও যে ঐসব করবে না, সে বিষয়ে তার মাকে আস্বস্ত করছে অর্থাৎ যে কোনো প্রতিকূল পরিবেশেই ছেলেটি ঐসব বাজে কাজ হতে দূরে থাকবে। শ্রীরামচন্দ্রও ঠিক এভাবে পরিহার অর্থে ও তার মাতাকে আস্বস্ত করা অর্থে হিত্বা বা ত্যাগ শব্দটি বয়বহৃত হয়েছে। আবার শ্রীমদ্ভাগবতের ৩য় স্কন্দের ১২ তম অধ্যায়ে পাওয়া যায়-

#(13)প্রথমে ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামক চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁরা সকলেই ছিলেন ঊর্ধ্বরেতা এবং তাই তাঁরা জড়জাগতিক কার্যকলাপে লিপ্ত অনিচ্ছুক ছিলেন। ৪ #(14) ব্রহ্মা তাঁর পুত্রদের সৃষ্টি করে বললেন, "হে পুত্রগণ! এখন তোমরা প্রজা সৃষ্টি কর।" কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেবের ভক্তিপরায়ণ হওয়ার ফলে, মোক্ষধর্মনিষ্ঠ কুমারেরা সেই কার্যে তাঁদের অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। ৫ (শ্রীমদ্ভাগবত-৩/১২/৪-৫)




এখন যদি বলা হয় চতুস্কুমারগণ সংসারধর্ম ত্যাগী ছিলেন। এখনে ত্যাগ বলা মানে পূর্বে তারা সংসার ধর্ম করতো এমন নয় কখনোই। তারা আদি কাল হতেই সংসারধর্ম ত্যাগী। এখানে ত্যাগ শব্দটি পরিহার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে অর্থাৎ তারা সংসার ধর্ম পরিহার করেছেন। এক্ষেত্রে তাদের ত্যাগটা পরিহার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে, পূর্বে কখনো গ্রহন করতেন এই অর্থে নয়। সেরূপ ভগবান রামচন্দ্রের ক্ষেত্রেও। রামচন্দ্রের বনে যাওয়ার পূর্বের কাহিনীতে মাংসাহারের কোনরূপ কথাই পাওয়া যায় না। তাই এখানে হিত্বা বা ত্যাগ শব্দ সর্ব অবস্থায় পরিহার ও মাতাকে এই ব্যাপারে আস্বস্ত করার জন্যই ব্যবহৃত হয়েছে।


পূ.প.- শ্রীরামচন্দ্র দ্বিচারী নয়, বুঝলাম। কিন্তু রামচন্দ্র তো তার মাতাকে ২.২০.২৯২.২০.৩১ এ নির্জন ও জনহীন অরণ্যে বাস করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু তিনি বনবাস কালে তো অধিকাংশ সময়ই ঋষিদের সঙ্গে থেকেছেন বা ঋষি আশ্রমের আশে পাশে থেকেছেন। তাহলে তা নির্জন হলো কিভাবে? এক্ষেত্রে রাম কি দ্বিচারী হলেন না?


উ.প.- এখানে আপনার বুঝতে কিছুটা ভুল হচ্ছে। নির্জনে বা জনশূন্য বলতে লোকালয়ে তথা গ্রামে বা উন্নত এলাকায় বসবাসকারী মানুষহীন বুঝানো হচ্ছে। কারণ পূর্বে অরণ্যসমূহে মুনি ঋষিদের আশ্রম থাকতো তারা সেখানে ধ্যান, সাধনা, তপস্যা করতেন। তারা সাধারণ লোকেদের থেকে আলাদা ছিলেন। তারা ভোগ, কাম্যকর্ম, মোহ এসব থেকে দূরে থাকতেন। তারা সময় অতিবাহিত করতেন তপস্যায়। মুনিরা তাদের আশ্রমে থেকে তপসয়া করতেন সেই আশ্রম গুলো "নির্জন অরণ্যে অবস্থিত" এরূপই বলা হতো। আশ্রমে একাধিক মুনিঋষিগণ থকতেন ও তপস্যা তপস্যা করতেন। তারা একত্রিত হয়েও তপস্যা কর্য করতেন। এবার মুনি ঋষিরা তো একত্রিত হয়েও তপস্যা বা ধ্যান করলেও তারা নির্জনে ধ্যান করেন বলা হত, অথচ তাদের সাথে বা আশে পাশে একাধিক জন থাকতো। এখানে নির্জন বা জনশূন্য বলতে মুনিশূন্য নয় বরং লোকালয়ে বসবাসকারী মানবশূন্য বোঝানো হয়। আর এজন্য রামচন্দ্র জনশূন্য, নির্জন বন বলার পাশাপাশি ভরদ্বাজ মুনিকে বলার সময় ২.৫৪.১৬ এ তপোবন শব্দটিও উল্লেখ করেছেন। অর্থাৎ রামচন্দ্র বিজনে, নির্জন, জনশূন্য বন বলতে তপোবনই তথা তপস্বীরা যেখানে অবস্থান করছেন সেই বন বুঝিয়েছেন।


পূ.প.- সুন্দর কান্ডে-৩৬/৪১ শ্লোকে "রাঘবো" শব্দ দিয়ে কি রঘুবংশ বুঝানো হচ্ছে? নাকি শ্রীরামচন্দ্রকে বুঝানো হচ্ছে?


উ.প.- প্রদত্ত গীতপ্রেসের রামায়ণের অনুবাদে রাঘবো শব্দের অর্থ রঘুবংশ করা হয়েছে। আবার অন্যান্য কিছু অনুবাদে রাঘবো অর্থ করা হয়েছে শ্রীরামচন্দ্রকে। ব্যকরণগত দিক থেকে দুটিই হয়। কেননা, #(15) ২.৮৬.৩-৪ নং শ্লোকে লক্ষণকে রাঘবনন্দন বলা হয়েছে, অর্থাৎ রঘুকুলের নন্দন সেই হিসেবে রাঘবো শব্দের অর্থ রঘুবংশ হয়।



আবার রামায়ণের বিভিন্ন শ্লোকে রামচন্দ্রকে রাঘব বলা হয়েছে সেই হিসেবে রঘুকুলপতি অর্থ রাঘব হতে পারে। দুইটিই গ্রহন করা যেতে পারে।


পূ.প.- যদি এখানে রাঘব শব্দে রাম ধরে নেই তবে তো, "রামচন্দ্র মাংস খান না" এমন অর্থ দাঁড়ায়। আবার রাঘব অর্থ রঘুবংশ ধরে নিলে, "রঘুবংশের কেউ মাংস খান না" এমন দাঁড়ায়। তাই তো?


উ.প.- হ্যাঁ।


পূ.প.- এবার দেখুন। উক্ত শ্লোকটি সীতা মাতার সাথে লঙ্কায় হনুমানের কথোপকথন। হনুমান বলছেন রামচন্দ্র কতোটা দুঃখে আছেন, সীতা মাতাকে ছাড়া। দুঃখ হেতু তিনি মাংস খাচ্ছেন না। কেননা পরবর্তী শ্লোকেই বলা আছে তার শরীরে কীটপতঙ্গ সরীসৃপ এসে পড়লেও তিনি তা সরান না। এরমানে কি রামচন্দ্র কখনোই শরীরে কীটপতঙ্গ বসলে সরাতেন না? মোটেই তা নয়, সীতামাতার বিরহে প্রভু শ্রীরাম এতোটাই দুঃখিত ছিলেন যে তিনি মাতা সীতার চিন্তায় উদাসীন থাকতেন। তাই এমন হতো। তাই বলা যায় যে শ্রীরামচন্দ্রের মাংসাহার না করাটা দুঃখবশত। সব সময়ের জন্য না।


উ.প.- আপনার ধারণা ভুল। উক্ত শ্লোকে হনুমান স্পষ্টই বলেছেন রামচন্দ্র মাংসাহার করেন না। এটা দিয়ে বুঝানো হচ্ছে যে সীতামাতার বিয়োগে তিনি দুঃখিত হওয়া সত্যেও কখনো তিনি তাঁর নিজ প্রতিশ্রুতি থেকে বিন্দুমাত্রও সরে আসেন নি। এর পরবর্তী শ্লোকে রামচন্দ্র দুঃখের বশবর্তী হয়ে উদাসীনতা বশত কি কি করতেন তা বলা হয়েছে। রামচন্দ্র বনে আসার পূর্বে কথা দিয়েছিলেন বনে গিয়ে তিনি মাংসাহার করবেন না, ফলমূলই আহার করবেন। আবার হনুমানও এদিকে বলছেন রামচন্দ্র মাংসাহার করেন না। তাহলে এবার এই কথাগুলোর ফলাফল দাঁড়াচ্ছে বনবাসে থাকা অবস্থায় তিনি মাংসাহার করেন নি। আর বনবাসের পূর্বে ও পরে মাংস খাওয়ার কোনো দৃষ্টান্তও নাই। সুতরাং ফলাফল হিসেবে কিন্তু রামচন্দ্র মাংসাহার করেন নি এটাই আসছে।


পূ.প.- আচ্ছা সব বুঝলাম। কিন্তু উক্ত শ্লোকে, মধু কি দোষ করলো? মধুপান কেন করছেন না? মধুপানে তো সমস্যা নাই। তারমানে এই বোঝা যাচ্ছে মাংস ও মধু উভয়ই তিনি দুঃখের তাড়নায় ছেড়ে দিয়েছেন।


উ.প.- এখানে গীতাপ্রেসের অনুবাদটায় মধু অর্থ মধুই রাখা হয়েছে। বাংলা অনুবাদে সরাসরি সংস্কৃত শব্দটাই গ্রহন করা হয়েছে অর্থাৎ তৎসম শব্দ গৃহীত হয়েছে। সংস্কৃত মধু শব্দের বহু অর্থই হতে পারে।মৌচাকের মধুও হতে পারে আাবার মদ্যও হতে পারে। এখানে মধুর মদ্য অর্থ গৃহীত হয়েছে। নিচে #(16) ইংরেজী রামায়ণ হতে, #(18) মহাভারতের ভারত কৌমুদী হতে দেখানো হচ্ছে যে মধু মদ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়।




এখন দেখুন কেউ দুঃখ পেলে তো মদ্য, মাংস আরো বেশি করে খাওয়ার কথা, কিন্তু এখানে হনুমান স্পষ্ট করে বলছেন রামচন্দ্র দুঃখে আছেন তথাপি তিনি তার কর্তব্য থেকে দূরে সরে মাংস, মদ্য গ্রহন করেন নি। কেননা তিনি মাংস গ্রহন করলে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করবেন, যেটা মর্যাদাপুরুষোত্তম রাম কখোনো করেন না। কেননা পূর্বে দেখানো হয়েছে রাম দ্বিভাষী নন। তাই এখানে এটাই প্রকাশ পায় যে রামচন্দ্র তাঁর কর্তব্য কর্মে অটল আছেন।


এরপর বনমধ্যে বাস করা কালীন সময়ের কাহিনীতে রামায়ণের বিভিন্ন শ্লোক দেখে আপাত দৃষ্টিতে রামচন্দ্রের মাংসাহারের আশঙ্কা জাগে। সেসব শঙ্কারও পরবর্তী পর্ব গুলোতে মীমাংসা করা হবে।


জয় জয় শ্রী শ্রী মর্যাদা পুরুষোত্তম ভগবান শ্রীরামচন্দ্র জী কী! জয়!


জয় শ্রী রাম


---- শ্রী প্রান্ত সাহা

20 views0 comments
Be Inspired
bottom of page